প্রভাত সংবাদ ডেস্ক : তাম্বুল বা পান বিলাস তখনই—যখন মুক্তোর চুণ আর কস্তুরী চুয়ার মশলা দিয়ে পান খেয়ে থাকেন নবাব বাদশারা এবং পান বিলাসিরা; আবার সমস্তদিন ঘ্যাস ঘ্যাস ক’রে ২০/ ৩০টা পান যাঁদের খেতেই হয়—তাঁদের হয় সেটা নেশা, কিন্তু দু’বেলা খাওয়ার পর দু’টো পান খাওয়ার অভ্যাস—সেটা হলাে স্বাস্থ্যসম্মত বিধি; তবে অসুস্থের জন্য নয়। এই পানকে নিয়ে উপমাবহুল লােককথা পল্লীবাংলায় মুখে মুখে আজও ফেরে; যেমন—-(১) ভালবাসার এমনি গুণ, পানের সঙ্গে যেমনি চুণ; বেশী হ’লে পােড়ে গাল, কম হলে লাগে ঝাল। (২) ছাগলের মুখে পড়লাে পান, পান বলে মাের গেল জান! (৩) পান থেকে চুণ খসলেই বিপদ। (৪) পানের পিকে রেঙেছে নয়ান, বানর মুখে কি শােভে পান? (৫) পানের সজ্জা পানের ডাবর পান মশলার বাটি, কন্যারে পাঠালেম আমি করি পরিপাটি। অতএব এই পান তাে আজকের নয়, সামাজিক মান্যতায় পানের সমাদর সবার আগে; কিন্তু এর আদিমান্যতা সেই বৈদিকযুগ থেকে চলে আসছে। এমনি সন্ধান নিতে গিয়ে দেখছি ঋক, যজ্ঞ, সামবেদে এই লতাগাছটির নাম খুজে পাওয়া যায় না, তবে খষ্টপূর্ব অন্ততঃ আড়াই / তিন হাজার বৎসরের অথর্ববেদেই এর সন্ধান পাওয়া যায়; সেখানে দেখা যায়, এটির বিভিন্নাংশ বিভিন্নগুণের আধার। এর বৈদিক নাম “সপ্তশিরা” (সব পানেই ৭টি প্রধান শিরা আছে), এই নামটির উল্লেখ আছে ৬৭ মণ্ডল ৫৩ সুতে।
তুমি সপ্তশিরা। তুমি নাগবল্লী। কফরােগ জন্য কণ্ঠরােধ ও তজ্জন্য স্বরাবরােধ, জ্বর ও বাতরােগ দূর কর। তখন অতি কষ্টে কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে। তাতে ব্যাকুল কণ্ঠে নিঃশব্দের মত শেষ হয়, জ্বর ও বাতরােগ। তোমার পত্র সেইসব রােগ দূর করে। তুমি যক্ষম (জবর রােগেরও নাম যক্ষ) দূর কর। তােমার ৭টি শিরা,সাতটি রােগকে হ্রাস-বৃদ্ধি করে। (একটি কথা এখানে বলে রাখি—এই কণ্ঠরােগ সম্পর্কে ভাষ্যকারের বর্ণনার সঙ্গে বর্তমান ডিপথিরিয়া রােগের লক্ষণের হুবহু মিল আছে।)
জাতি ও গােষ্ঠী সমগ্র ভারতে ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে বিভিন্ন স্বাদের ও গন্ধের বিভিন্ন প্রকার পান পাওয়া গেলেও, পাশ্চাত্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে তারা সকলেই Piperaceae ফ্যামিলীভুক্ত, এর বােটানিক্যাল নাম Piper betle Linn.; কিন্তু আয়ুর্বেদ অনুবতীদের মতে বিভিন্ন প্রকার পানের গুণগত পার্থক্য অনেকদিন থেকেই রয়েছে।
এক নজরে পানের রসের দোষ-গুণ- (১) এটি বলকারকও যেমনি, বলহানিকরও তেমনি; অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে। (২) নবপত্র (নতুন পাতা) শ্লেষ্মা বৃদ্ধি করে, পুরাতন পান লেম্মা দুর করে। (৩) পরিপাক শক্তি যেমন বৃদ্ধি করে, অপব্যবহারে তেমনি আবার অজীণও সৃষ্টি করে। (৪) পাতার রস বিশেষ ইন্দ্রিয়ের শক্তিতে বলাধানও করে, আবার শিরা (বোঁটা সমেত প্রধান শিরা) খেলে ইন্দ্রিয়ের বলহানিও করে। (৫) শরীরের চামড়ায় এর রস দাহ সৃষ্টি করে, আবার দগ্ধ চামড়ায় এর রস স্নিগ্ধতাও নিয়ে
(৬) এর পাতার রস মুখের জড়তা ও অরুচি দূর করে, আবার এই পানের রস বাসি হলে ঠিক এইগুলিই বাড়িয়ে দেয়। কোথায় কিভাবে কাজে লাগে খাওয়ার পর একটি করে পান খেলে মুখে যে লালা নিঃসরণ হয়—তাই হয় হজমের সহায়ক, এই পর্যন্তই অনেকের জানা; কিন্তু আর একটি অন্তর্নিহিত শক্তি এর আছে—যেটি গ্রহণীনাড়ীর আকুঞ্চন-প্রসারণ শক্তি (peristoltic movement) বাড়িয়ে দেয়, আবার বেশী খেলেও এ কাজটি খুবই মন্দীভূত হয়। এটি নব্য বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা আসে।
রােগ-প্রতিকারেঃ
==============
(১) পানের রােগ-নাশিনী শক্তি সম্পর্কে সর্বাগ্রে মনে রাখতে হবে যেখানে শ্লেষ্মপ্রধান রােগ, সেখানেই তার প্রভাব বেশী; তাই রসতাত্ত্বিক আয়ুর্বেদজ্ঞগণ ঔষধেরসহপানে পানের রস বেশী ব্যবহার করেন।
(২) দাঁতের মাড়ির দষিত ক্ষতে পুঁজ জমতে থাকলে পানের রসের সঙ্গে অল্প
জল মিশিয়ে কলকুচি করলে ওখানে আর পুঁজ জমে না; ক্রমশঃ ক্ষত শুকিয়ে যায়।
৩) পুরাতন দাদ বা চাপড়-চুলকানিতে পানের রস ঘষে দিলে কয়েক দিনেই ও অবস্থাটার অবসান হয়।
(৪) কানের পুঁজে এর রস গরম করে ২১ ফোঁটা কানে দেওয়ার বিধি গ্রামাঞ্চলেতাে আছেই।
(৫) হাতে-পায়ে, হাজায়— পানের রস অল্প গরম করে রাত্রে লাগিয়ে রাখুন। উপশম হবে—তবে এটাও ঠিক যে, হেতুটা বর্জন না করলে সে তো আবার হবেই।
(৬) নখকুনির কষ্টে পানের রস গরম করে দিনে ৩/৪ বার নখের কোণে দিলেব্যথা থেকে রেহাই হয়, তবে নখের ঐ বুদ্ধিটকু কাটতেই হয়।
(৭) ফোড়ায় পানের পাতার সােজা পিঠে ঘি (পুরাতন হলে ভাল হয়) মাখিয়ে ফোড়ার উপর বসিয়ে দিলে ফোড়া পাকে ও ফাটে; আবার এইভাবে পানের উল্টোপিঠ ফোড়ায় বসালে ওটা পুঁজ টেনে বার করে শুকিয়ে দেয়; (অবশ্য একটু গরম করে নিতে হয়)। এখানে আর একটা কথা বলে রাখি—পানের পাতায় পচন-নিবারক উদ্বায়ী
তৈল আছে, যার জন্য ঐ ফোড়া বিসর্পিত হতে পারে না।
(৮) মাথায় উকুন হলে পানের পাতার রস মাথায় লাগিয়ে দেখুন—ওরা সবংশে চলে যাবে। (তবে ঝাল পান হলে ভাল হয়। এ পানের গঠন একটু মােটা হয়।)
(৯) গর্ভনিরােধ পানের শিকড় বেটে খাওয়ালে ছেলেপুলে হয় না—একথা গ্রামাঞ্চলের মধ্যে কানাঘুষাে শুনতাম, এখন দেখি বর্তমানের প্রামাণ্য গ্রন্থ Glossary of Indian Medicinal Plants- এ এ-কথা লেখা আছে। রােগ-প্রতিকারে এই পানের
ব্যবহার আরও হয়তাে অনেকের জানা আছে।
পান খাওয়া উচিত নয়ঃ-
================
(১) রুক্ষ ও দুর্বল ব্যক্তির, (২) মুছা রােগীর ও যার চোখ উঠেছে, (৩) রক্তপিত্তে, ক্ষয় ও যক্ষা রােগীর, (৪) অতিরিক্ত নেশার পর।
তথ্য সূত্রঃ চিরঞ্জীব বনৌষধি।