স্টাফ রিপোর্টার
তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজ ও ভয়ঙ্কর কিলার শেখ গোলাম মোস্তফা ওরফে ট্যারা মোস্তকে গ্রেফতার করেছে কেএমপি। আটক ট্যারা মোস্ত ওই এলাকার শেখ আবুল হোসেনের ছেলে। নগরীর খুলনার পূর্ব ও দক্ষিণ পাশ ঘিরে ট্যারা মোস্ত গড়ে তুলেছে এক অঘোষিত সন্ত্রাসের রাম রাজত্ব। শুধু খুলনা শহর নয়, তার আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে জেলার বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও রূপসা থানা এলাকায়। যার ভয়ে অনেক মানুষের ঘুম হারাম হয়েছে দিনের পর দিন। হত্যা, চাঁদাবাজি আর ভূমিদস্যুতা তার ছিল প্রধান কাজ।
পুলিশ কমিশনার মোঃ মোজাম্মেল হক বুধবার কেএমপি’র সদর দপ্তরস্থ সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টায় লবণচরা থানার একটি টিম একই থানার বান্দাবাজার এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে।
ট্যারা মোস্তর নামে জেলাসহ ও খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন থানায় ৮টি হত্যা, ৪টি চাঁদাবাজি, ১টি জালিয়াতি, ১টি অস্ত্র আইনে ছাড়াও বিভিন্ন ধারায়-১২টি মামলাসহ সর্বমোট ২৬টি মামলা রয়েছে।
কে এই ট্যারা মোস্ত!: খুলনা শহরের লবণচরা এলাকায় ‘ট্যারা মোস্ত’র পাপের সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত যে, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছে তিনি ‘ভয়ঙ্কর কিলার’ হিসেবে এক নামে পরিচিত।
পুলিশের হিসাবে ২৬ মামলার চিহ্নিত এই আসামির পুরো নাম শেখ গোলাম মোস্তফা (৪৭)। নগরীর লবণচরা থানার বান্দাবাজারের সিমেন্ট ফ্যাক্টরী রোডের শেখ আবুল হোসেনের ছেলে তিনি। দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকা ও একটি চোখ ট্যারা হওয়ায় পুলিশের বিশেষ শাখার তালিকায় তাকে ‘ট্যারা মোস্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভয়ঙ্কর এই খুনির নামে পুলিশের কাছে রয়েছে ৮টি হত্যা মামলার নথি। এছাড়া চাঁদাবাজি, অপহরণ, বিস্ফোরকদ্রব্য ব্যবহার, হত্যা চেষ্টা, সরকারি কাজে বাধাদান, দ্রুত বিচার আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হয়েছে। শতাধিক অভিযোগ ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পড়ে আছে খুলনা সদর, ডুমুুরিয়া, বটিয়াঘাটা, লবণচরা ও রূপসা থানায়।
খুলনা শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে খানজাহান আলী সেতু (রূপসা ব্রিজ) পর্যন্ত এলাকায় জমির দখলদারি ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে এই ‘ট্যারা মোস্ত’র সন্ত্রাসী কার্যক্রম। জমির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য লবণচরার বান্দাবাজারে তার ব্যক্তিগত কার্যালয় রয়েছে। সেখানে বসেই ওই এলাকার জমিজমা সংক্রান্ত সব বিচার-সালিশ করেন তিনি। কেউ তার বিচার না মেনে নিলে হামলার শিকার হন।
ট্যারা মোস্ত সর্বশেষ গ্রেফতার হন ২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বরে। ওইদিন ১০-১২ জন সহযোগীর সঙ্গে ছোরা, রামদা, চায়নিজ কুড়াল, চাপাতি, লোহার রড নিয়ে আব্দুল গফ্ফার নামের এক তরুণের ওপর হামলা চালান তিনি। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গফ্ফার জ্ঞান হারালে তাকে মৃত ভেবে তারা সরে যান। হামলার শিকার গফ্ফার প্রাণে বাঁচলেও পঙ্গু হয়ে গেছেন। ওই ঘটনায় আব্দুল গফ্ফারের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার সাথি হত্যাচেষ্টা মামলা করলে ট্যারা মোস্ত গ্রেফতার হন। তবে কিছু দিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে ফের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেন।
এর আগে স্থানীয় স্বপ্না বেগমের করা চাঁদাবাজি ও প্রতারণা মামলায় ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর ট্যারা মোস্তকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। একই থানায় ২০১৮ ও ২০১৫ সালেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় মামলা হয়েছে।
লবণচরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক বলেন, ট্যারা মোস্তর সঙ্গে স্থানীয়দের দ্ব›েদ্বর মূলে জমির ব্যবসা ও দখলদারিত্ব। অন্যের জমির জাল কাগজপত্র বানিয়ে বিক্রি করে দেন তিনি। জমি ব্যবসার জন্য মাধ্যম হয়ে কাজ করলেও কোথাও নিজের নামে জমির দলিল বা নথি তৈরি করেন না। তাই তাকে সহজে আইনের জালে আটকানো যায় না।
পুলিশের পিসিপিআর (পূর্বের মামলার পরিসংখ্যান) থেকে জানা গেছে, ট্যারা মোস্ত খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ শাখার তালিকাভুক্ত একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও লবণচরা থানার তালিকাভুক্ত ১ নম্বর ভূমিদস্যু। তিনি সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন ১৯৯৫ সালে। ওই বছরের আগস্ট মাসে খুলনা সদর থানায় তার বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধার অভিযোগে মামলা হয়। পরের মাস সেপ্টেম্বরে বিস্ফোরক আইন এবং নভেম্বরেও বিস্ফোরক ও ছিনতাই আইনে তার বিরুদ্ধে একই থানায় মামলা হয়।
এছাড়া ট্যারা মোস্তর বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা হয় ২০০৩ সালের জুলাই মাসে খুলনা সদর থানায়। একই থানায় সেপ্টেম্বরে আরেকটি হত্যা মামলা হয়। ২০০৪ সালে তার নামে হত্যা মামলা হয় খুলনার ডুমুুরিয়া থানায়। এরপর ২০১০, ২০১২ ও ২০১৩ সালের খুলনা সদর থানায় এবং ২০১৩ সালের জুলাইয়ে খুলনার বটিয়াঘাটা থানায় ধারাবাহিকভাবে হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন তিনি।
এক সময় ভাড়াটে সন্ত্রাসী হয়ে কর্মকান্ড পরিচালনা করলেও ২০১০ সাল থেকে নিজেই জমির দখলে নজর দেন ট্যারা মোস্ত। কোনো পক্ষের হয়ে জমির দখল, উচ্ছেদ বা অন্যের জমির জাল দলিল করে দখলে নিতে শুরু করেন।
পুলিশের তথ্যমতে, ২০ থেকে ২৫ জন নিয়ে গঠিত ট্যারা মোস্তর সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে চাঁনমারী বাজারের আশিক, একই এলাকার মিজান ওরফে বস মিজান, সুরুজ, বান্দাবাজারের মোঃ গোলাম মোস্তফা, উকিলের কালভার্ট এলাকার সোহেল, গেদনপাড়ার আব্দুলাহ, আলামিন মৃধা, বেলাল, হেলাল ও মোক্তার হোসেন রোডের পারভেজ উলেখযোগ্য। এদের মাধ্যমেই লবণচরা এলাকায় জমি দখল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি।
আরও অনেকের মতো ট্যারা মোস্ত বাহিনীর কাছে পৈতৃক সম্পত্তি হারিয়েছেন ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার পৈতৃক সম্পত্তি খুলনার লবণচরা এলাকায়। আমরা ঢাকাতে বসবাস করি। দুই বছর পর গ্রামে গিয়ে দেখি অন্যরা আমাদের জমিতে ঘর বেঁধে বসবাস করছে। তাদের কাছে গিয়ে জানতে পারি, ট্যারা মোস্তর মাধ্যমে তারা ওই জমি কিনেছেন। আমাদের জমির জাল কাগজ বানিয়ে ট্যারা মোস্ত বিক্রি করে দিয়েছেন।
ফরিদুল আরও বলেন, ট্যারা মোস্তর প্রভাব এত বেশি যে, পুলিশও তার কিছুই করতে পারে না। তাকে বারবার গ্রেফতার করা হলেও কালো টাকার প্রভাবে ছয় মাসের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যান। তার সঙ্গে শত্র“তা করলে জীবনের নিরাপত্তা থাকে না। তাই জমি উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছি।